জেমস রহিম রানা
প্রার্থী সমর্থকদের মধ্যে চরম আতঙ্ক ও উদ্বেগ উৎকন্ঠার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে যশোরের ইউপি নির্বাচনের প্রচার প্রচারণা। প্রার্থীরা তাদের প্রতীক পাওয়ার পরে ইউনিয়নব্যাপী মাইকিংসহ অলি গলি ছেয়ে ফেলছেন পোষ্টারে পোষ্টারে। দলীয় মনোনয়ন প্রাপ্ত প্রার্থীদের পাশাপাশি স্বতন্ত্রভাবে প্রতিদ্বন্দ্বীতাকারী সকল প্রার্থীরা নেমে পড়েছেন নির্বাচনী মাঠে। সব প্রার্থীই মনে করছেন শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলে তিনিই হবেন এবারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। গতকাল মঙ্গলবার সদর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন ঘুরে উঠে এসেছে এমন তথ্য।
হৈবতপুর ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের মনোনীত নৌকার মাঝি আবু সিদ্দিক হোসেন জানান, জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের কোন কোন অনুসারী নৌকার সাথে বিরোধীতা করে যাচ্ছে। কিন্তু যারা আওয়ামীলীগের একনিষ্ঠ লোক তারা নৌকার পক্ষেই প্রকাশ্যে রয়েছেন। তার নামে বিভিন্ন অভিযোগের কথা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, আমি একজন শান্তিপ্রিয় মানুষ। আমার সমর্থকদেরও সাথে নিয়ে শান্তির সাথে জনগনের দ্বারে দ্বারে ভোট ভিক্ষা করছি। যদি সুষ্ঠ নির্বাচন হয় এবং জনগন যদি ভোট দেয় তবে আমি আশাবাদী নৌকামার্কা বিজয়ী হবে। তিনি বলেন, আমাদের ইউনিয়নের কোন মারামারি হয়নি আর যেটা শুনেছেন সেটা ভিত্তিহীন।
এই ইউনিয়নের শক্তিশালী ও জনপ্রিয় স্বতন্ত্র প্রার্থী হরেন কুমার বিশ্বাস জানান, আমি দীর্ঘদিন যাবত আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকলেও দল আমাকে মূল্যায়ন করেনি। কিন্তু এলাকার জনগন আমাকে সুখ দুঃখের সাথি হিসেবে মনোনীত করায় আমি নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছি। যেকারণে দলের নেতাকর্মীদের অব্যাহত হুমকি ও নির্যাতনে আমাকে স্ব-পরিবারে বাড়ি ছাড়া হতে হয়েছে। শুনেছি আজ দল আমাকে বহিস্কার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও সেটা সম্পূর্ণ অনিয়মতান্ত্রিকভাবে হবে। কারণ সেটা দলের কতিপয় নেতার একক সিদ্ধান্ত । তারপরও আমিও সে সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মোটরসাইকেল প্রতীক নিয়ে মাঠে নেমেছি।
তিনি অভিযোগ করেন, আমি নির্বাচনে মনোনয়ন দাখিলের পর থেকেই নৌকা মার্কার প্রার্থী আবু সিদ্দিক এর সন্ত্রাসী বাহিনী আমার পরিবারের উপর হুমকি দিয়ে আসছে এবং আমার দুই সন্তানকে জীবননাশের হুমকি দিয়েছে। আমাকে রাতের আধারে মুখোশধারী লোকেরা দুইবার হামলা করেছে। তাদের একটাই দাবি আমাকে নির্বাচন হতে সরে দাঁড়াতে হবে নতুবা আমাকে জীবনে মেরে ফেলবে। একপর্যায়ে সন্ত্রাসীদের চাপের মুখে আমি স্ব-পরিবারে বাড়ি ঘর ছেড়ে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হই। অবশেষে ইউনিয়নের জনগণের ভালবাসার কাছে নত হয়ে তাদের সম্মাণ রক্ষার্থেই আমি নির্বাচন করতে বাধ্য হয়েছি। আমার প্রতীক পর্যন্ত আমি আনতে যেতে না পারায় সমর্থকরাই এনেছেন। দীর্ঘ ১৫দিন যাবৎ আত্মগোপনে থাকার পর আজ ইউনিয়নবাসি দলমত নির্বিশেষে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের ভালবাসার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। তিনি বলেন, আমি একজন আওয়ামীলীগ পরিবারের সন্তান। ১৯৮১ সালে আমি ছাত্রলীগ করাকালীন সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সর্বপ্রথম যখন খুলনায় আসেন তখন আমি নিজে তাকে রিসিভ করি। সে সময় দেশনেত্রীআমাকে জড়িয়ে ধরে জোরে কান্না করেছিলেন। আজ সেই কান্না করতে হচ্ছে আমাকে। আমার উপর এই জুলুম অত্যাচারের প্রতিকার চাই। তিনি বলেন এই ইউনিয়নের সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আমি জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত হব। তার দাবি প্রশাসন যেন ইউনিয়নে কড়া নজর রাখেন।
হৈবতপুর ইউনিয়নের অপর স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের জেলা সহসভাপতি আনারস প্রতীক পাওয়া আহম্মদ আলী অভিযোগ করে বলেন, দলের মনোনয়ন না পেলে নির্বাচন করা অনেক কঠিন। দলের নেতা-কর্মীরা অনেকে হুমকি-ধামকির মধ্যে আছে। আমি আমার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নির্বাচনের প্রচারে যেন বাইরে বের না হতে পারি তার জন্য তারা নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে। সমর্থকদের ভোটের মাঠে যেতে নিষেধ করা হচ্ছে। দল থেকে বহিস্কারের বিষয়ে তিনি বলেন, বহিস্কারের ব্যাপারে আমাকে কোন কিছু জানানো হয়নি। আমি বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের জেলা সহসভাপতি । মূল দলের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে দল ইচ্ছা করলে যেকোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে তাতে আমি ভিত নই। শুনেছি আজ দল আমাকে বহিস্কার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও সেটা সম্পূর্ণ অনিয়মতান্ত্রিকভাবে হবে। কারণ সেটা দলের কতিপয় নেতার একক সিদ্ধান্ত । দলীয় যেকোন সিদ্ধান্ত নিতে হলে বোর্ডের সিংহভাগ নেতাদের উপস্থিতি থাকতে হবে। কিন্তু আজকের সিদ্ধান্তের সময় কারা ছিলেন বা কয়জন ছিলেন সেটা আমার জানা নেই।
তিনি বলেন, গতকাল সোমবারও আমার এলাকার বিভিন্ন ওয়ার্ডে পুলিশ যেয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে এসেছে বরল জেনেছি। তিনি বলেন সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এবং ভোটাররা ভোট দিতে পারলে আমি বিজয় লাভ করব।
এদিকে, চুড়ামনকাটি ইউনিয়নের নৌকা প্রতীকের মাঝি দাউদ হোসেন জানান, নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে আশাকরি আমি ১০ হাজার ভোট বেশি পাব। সাধারণ মানুষ ভোটের মাঠে যেন শান্তিপূর্ণভাবে যেতে পারে সে আশা করছি। আওয়ামী লীগের মূল কমিটির লোকও আমার সাথে আছেন। দল-মত-নির্বিশেষে ইউনিয়নের লোক আমার পক্ষে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি অভিযোগ করেন, ইউনিয়নে কিছু ভাসমান ভোট আছে যেখানে মুন্না গ্রæপের লোক বিভিন্ন সময় হুমকি-ধমকি দিয়ে যাচ্ছে।
অপরদিকে এই ইউনিয়নের স্বতন্ত্র প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান মুন্না বলেন, আমি বিগত দিনে ইউনিয়নবাসির জন্য যে কাজ করেছি তাতে জনগন আমার বাইরে অন্য কোন প্রার্থীকে ভোট দেয়ার কথা না। তারপরও সকলের মন রক্ষা করা একজনের পক্ষে কখনো সম্ভব হয়না। নির্বাচনে দাড়িয়েছি ভোটারদের অনুপ্রেরণায়। শেষ সিদ্ধান্ত ভোটাররাই নেবেন । তিনি গতকাল বিবকলে চুড়ামনকাঠির হযরত পাখি শাহ এর মাজার থেকে তার নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন।
এছাড়া কাশিমপুর ইউনিয়ন এর নৌকার মাঝি সাইফুল ইসলামও তার কর্মী সমর্থকদের নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন। তিনি জানান, আমার প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী হলো আইয়ুব হোসেন। ইউনিয়নের ৭০ ভাগ ভোটার আমার সাথে একযোগে কাজ করছে। সুষ্ট ও শান্তপিূর্ন নির্বাচন হলে আমি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হব।
উল্লেখ্য, আগামী ৫ জানুয়ারি যশোর সদর উপজেলার ১৫টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সোমবার শেষ হয়েছে প্রার্থীদের মাঝে প্রতীক বরাদ্দ। এরই সাথে প্রচার প্রচারণায় মাঠে নেমে পড়েছেন প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা।
এই নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীদের চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন আওয়ামী লীগেরই বিদ্রোহী দেড় ডজন প্রার্থী। যাদের প্রচার প্রচারণা ও ভোটারদের সিদ্ধান্তের ওপর বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থীর জয়-পরাজয় নির্ভর করবে। ইতিপূর্বে বৈধ প্রার্থীদের নাম ঘোষণার পর সব ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে বর্ধিত সভা করা হয়েছে। ওই সব সভা থেকে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলনসহ প্রভাবশালী নেতারা বিদ্রোহী প্রার্থীদের কঠোরভাবে হুঁশিয়ারী দিয়েছেন। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের দিন পার হওয়ার পর বিদ্রোহীদের মাঠে নামতে না দেয়ারও হুমকি দিয়েছিলেন তারা। কিন্তু আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা ওই সকল নেতাদের তর্জন গর্জনের কোন তোয়াক্কা না করেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সোমবার তাদের নিজ নিজ প্রতীক বুঝে নিয়েছেন।
সূত্রমতে, উপজেলার ১৫টি ইউপির মধ্যে নওয়াপাড়া ইউনিয়নে ইভিএম (ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন) এর মাধ্যমে ভোটগ্রহণ করা হবে। বাকি ইউনিয়নগুলোতে ব্যালটের মাধ্যমে ভোট নেয়া হবে বলে সদর উপজেলা নির্বাচন অফিসার বাদল চন্দ্র অধিকারী জানিয়েছেন।
Leave a Reply