ডেস্ক রির্পোটঃ রতনদা’র সাথে অনেক দিন পরে দেখা। লোকটার বৈশিষ্টই এমন। হারিয়ে যায় হঠাৎ হঠাৎ। অবশ্য হারিয়ে যাওয়া মানে এলাকা ছাড়া হওয়া নয়। আমাদের আসরে খুঁজে পাওয়া যায়না । ফোন দিলেও ধরেনা। মাঝে মাঝে ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
তো অনেকদিন পরে দেখা হওয়াতে মিজান,হাফিজ,কেষ্টসহ সবাই খুব খুশি। খুশি হওয়ার কারণও আছে। আসর জমিয়ে রাখার উস্তাদ সে। সিগারেটের ধোয়ার কুন্ডুলির সাথে তার সত্যের মুখোমুখি হওয়ার রুপকধর্মী কথাগুলো যেন মিলে-মিশে একাকার হয়ে যায়।
বেশ মনে আছে—
একদিন সে নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো,এদেশে ন্যায্য বিচার নেই। মানি লোকের মান নেই। কেন জিজ্ঞাসা করতেই সে যা উত্তর দিল,তাতে হা হয়ে গেল সবাই।
মোটরবাইকে আসছিলো সে। লিছু তলার মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ আটকে হেলমেট নেই কেন জানতে চাইল। রতনদা বললো,আমি বাসা থেকে বাজার করার উদ্দেশ্যে বের হয়েছি। বড় রোডে উঠব না। তাই আর হেলমেট আনিনি। বাকী কাগজপত্র এগিয়ে দিতেই ট্রাফিক কনস্টেবল শুরু করল চরম দূর্ব্যবহার। তাছাড়া পোশাকী সাহেবিপনায় রতনদা’র একটু ঘাটতি রয়েছে। যারা কেতা-দুরস্ত ভাব দেখাতে পছন্দ করে তাদের উদ্দেশ্যে সেই কবে তার বাবা বলেছিলেন-রতন,ওদের যা কিছু আছে,কাছেই আছে। সেজন্য ঠাট-বাট একটু কম রয়েছে তার।
মেজাজ আরও চরমে উঠে গেল,ট্রাফিক পুলিশের ‘তুমি’ সম্বোধনে। হেলমেট ছাড়া মাথা বাচাবে কি করে? দরদ উথলে উঠছে ট্রাফিক পুলিশের!
ট্রাফিক পুলিশ বুঝতে পেরেছে,হেলমেট ছাড়া আর সব আছে তার কাছে। অনুনয়-আবেদন করা যেহেতু অভ্যাস নেই রতনদা’র অভিধানে। তাই ব্যাখ্যা আকারে বললো,দেখুন,সার্জেন্ট সাহেব,আমি আগেই বলেছি,আমার বাসা পাশেই। বাজার করতে এসেছিলাম। মোটরসাইকেল উঠানে ছিল। এটুকু আসতে আর হেলমেট পরিনি।
‘স্যার’ না বলায় বিনয়ী যুক্তিটা খুব বেশি ভাল লাগেনি সম্ভবত স্যারের। অবশেষে সার্জেন্ট কেসস্লিপ ধরিয়ে দিতে যাবে,ঠিক সে সময়ে পাশ দিয়ে যাচ্ছিল একখান নসিমন ও আরেকখান ভটভটি। যাওয়ার সময় সজোরে ছেড়ে যাওয়া কালো ধোয়ায় ভরে গেল চারপাশ। কাশতে শুরু করলো,পুলিশসহ সবাই।
যুৎসই জবাব দিতে পারবে বলে তক্ষুণি রতনদার চোখ চক-চক করে উঠলো।
সে খেকিয়ে উঠে বললো,এই যে সাহেব, নসিমন-ভটভটির চালকদের সিগন্যাল দিলেন না কেন ? ওদের তো মাথায় হেলমেট নেই। ওদের ওই যন্ত্রদানব কি পায়ের প্যাডেলে চলে?
রতনদা’র এই কথা শুনে আরো খেঁপে গেল কনস্টেবল। চিৎকার করে ‘তুই’‘তুকারি’ শুরু করলো। তবে এসব শোনার মত এতটা দুর্বল চিত্তের মানুষ নয় রতনদা। বজ্রকণ্ঠে বলা শুরু করলো—আমি এই দেশের প্রথম শ্রেণির নাগরিক। ন্যায্য কথা বলার অধিকার আমার আছে। হেলমেট না পরা অপরাধ-আমি সেটা জানি। এই অপরাধের জন্য ৩ হাজার টাকার কেস স্লিপ দিয়েছেন। আমি মেনে নিয়েছি। কিন্তু সড়ক-মহাসড়কে,এমনকি অলি-গলি,পাড়া-মহল্লায় নসিমন-করিমন-ভটভটি-ইঞ্জিনভ্যান দাপিয়ে বেড়াবে,তারা মানুষ হত্যা করবে,তাদের কোন ড্রাইভিং লাইসেন্স লাগবেনা,নিবন্ধন লাগবেনা,মাথায় হেলমেট পরা লাগবেনা, কালো ধোয়ায় পরিবেশ নষ্ট করবে- এটা কেমন কথা! তাদের বেলায় ট্রাফিক আইন অচল,আর মোটরসাইকেল চালানো ভদ্রলোকদের পান থেকে চুন খসলেই ঝাড়ি-জরিমানা! পাবলিক সব বোঝে-বুঝলেন। একনাগাড়ে কথাগুলো বললো রতনদা’। তবে সেদিন একটু ব্যতিক্রম ছিল। অনেকগুলো কথা বলার পরে স্বভাবগতভাবেই একটু হাঁপাতেন তিনি। তবে সেদিন আর হাঁপাননি। অনেক কষ্টে নিজের ভাব বজায় রাখলেন।
সেই থেকে বাইকে সর্বদা হেলমেট রাখেন তিনি। সেদিন সন্ধ্যায় চায়ের দোকানের সেই আড্ডাতেও আসলেন হেলমেট পরে। আমরা তো হাসতে হাসতে খুন। রতনদা’র হেলমেটের গ্লাসটা আবার আড়াআড়ি ভেঙে গেছে। তা দেখে সজীব বললো-তোমারতো চোখ নষ্ট হয়ে যাবে,রতনদা’। বিজ্ঞের মত উত্তর এল-চোখ নষ্ট হওয়ার চেয়ে চোখের পর্দা রাখাই উত্তম।
যাক আসল কথাই ফিরে আসি। সপ্তাহ খানেক আগের কথা। রতনদা’র বাড়িতে ঘটে গেছে এক ভয়ঙ্কর ঘটনা। দো-তলার ঘরে ঘুমিয়ে ছিলো দাদা-বৌদি। গরম বেশি থাকায় জানালা দরজা খোলা ছিল। তাছাড়া দক্ষিণা বাতাসের সাথে মিতালি করে রতনদা’র আবার বাউল গান গাওয়ার অভ্যাস। গান গাইতে গাইতে ঘুমিয়ে গেছে সে। ঘুম ভেঙে দেখে-সে হাসপাতালে। নিজের চোখকে বিশ^াস করতে পারছিলনা। আশ্চর্য! যতটুকু মনে আছে, রাতে জানালা-দরজা খুলে ঘুমিয়েছিলাম।
আমি এখানে কেন? এটাতো হাসপাতালের বেড! তাইতো, আমার খাটতো পাঁচ হাত চওড়া। আর এটাতে ডান থেকে বামে কাত হলেই পড়ে যাওয়ার উপক্রম। রতনদা’ এবার নিজে নিজে গায়ে চিমটি কাটলেন। নাহ! ঠিকই আছে তো। কৃষ্ণা কই?
পাশ থেকে রতনদা’র ভাইপো সজল উত্তর দিল-
কাকা,গতকাল রাতে চেতনানাশক স্প্রে করে তোমাদের অজ্ঞান করেছিল দুর্বৃত্তরা। তোমাদের কাপড়-চোপড়-টাকা-পয়সা,সোনা-দানা সব নিয়ে গেছে।
সেই পুরনো অভ্যাসের মত মাথা চুলকাতে চুলকাতে রতন’দা বললো, বুঝেছি। তোর কাকী কই রে?
আছে হাসপাতালের মহিলা ওয়ার্ডে-উত্তর দিল সজল।
আমাকে নিয়ে চল-তোর কাকীর কাছে-বলেই যেই উঠতে যাবে রতন’দা,অমনি মাথা ঘুরে পড়ে গেল।
কিছুক্ষণ পরে সে আবারো ধাতস্থ হয়ে সজলের ঘাড়ে ভর রেখে মহিলা ওয়ার্ডে গেল।
কৃষ্ণা বৌদি তো রতনদাকে দেখে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। একপর্যায়ে বৌদি বলে বসল,আমার সব নিয়ে গেছে চোরেরা। কানের দুল,চেইন,ব্রেসলেট,চুড়ি,টিকলি-সব-সব,কিছুই রাখেনি। এখন আমার কি হবে গো—। বলে আবারও কাঁদতে লাগল।
রতনদা শান্ত গলায় বললো, কেদনা, কৃষ্ণা। চোরেরা সব নিয়ে গেছে,কিন্ত জীবনটাতো নিয়ে যায়নি।
সজোরে ব্রেক কষার মত কান্না থেমে গেল বৌদির। তাইতো,চোরেরা অজ্ঞান করে সব লুটে নিয়ে গেছে। কিন্তু পরবর্তী ঝামেলার ভয়ে যদি আমাদের দু’জনকে ওরা মেরে ফেলত,তাহলে? হাসপাতালের পরিবর্তে আমাদের এখন ঠাই হত শ্মশানে,শেষ কৃত্তে। সান্তনাসূচক এমন গুরুগম্ভীর বাক্য বলায় কৃতজ্ঞতায় স্বামীকে প্রণাম করতে ইচ্ছে করছিল তার।
Leave a Reply