মোঃ রাসেল সরকার//
ব্যস্ত শহর ঢাকায় যানজট নিত্যদিনের সমস্যা। দিনকে দিন এই দুর্ভোগ আরও প্রকট আকার ধারণ করছে। এই দুর্দশার মধ্যেও প্রতিনিয়ত সড়কে নামছে নতুন নতুন যানবাহন। গাড়ির মিছিল দীর্ঘ হলেও সড়ক বাড়ছে না, উল্টো সংকুচিত হচ্ছে। ঢাকার রাস্তাগুলোর পুরোটা নগরবাসী ব্যবহার করতে পারে না, অনেকাংশই দখল হয়ে আছে চাঁদাবাজদের হাতে । বেশিরভাগ সড়কে দোকান বসানো আর গাড়ির পার্কিংয়ের কারণে ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ জায়গা দখল হয়ে যায়।
সড়কে অবৈধ পার্কিংয়ের মাধ্যমে দুই লেনের সড়ককে অর্ধেক লেনে নামিয়ে এনেছে যাত্রীবাহী লোকাল বাসসহ বিভিন্ন যানবাহন। কোথাও কোথাও সড়কের একাংশ দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে ট্রাক-টেম্পো-লেগুনা-অটোস্ট্যান্ড। দখল হয়ে গেছে বিভিন্ন ফ্লাইওভারের নিচের অংশও। বিভিন্ন বাস টার্মিনালের সামনের রাস্তাগুলো পরিণত হয়েছে পার্কিং জোনে। এছাড়া ঢাকার প্রায় সব সড়ক ও ফুটপাতের একাংশ চলে গেছে হকার ও ভ্রাম্যমাণ দোকানদারদের দখলে। সড়কের জায়গা দখল করে প্রতিনিয়ত ভাড়া আদায় করছেন প্রভাবশালীরা। এছাড়া প্রতিদিন স্থানীয় রাজনীতিবিদ, মাস্তান-সন্ত্রাসী এমনকি কোথাও কোথাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও কোটি কোটি টাকা চাঁদা আদায় করছেন।
নাজেহাল অবস্থা পুরান ঢাকার : ঢাকার প্রবেশপথগুলোর একটি যাত্রাবাড়ী এলাকা। এখানে ফ্লাইওভারের নিচে সকাল থেকে প্রায় সারাদিনই বসে মাছের বাজার। সড়কের উপরে মাছের বাজার বসার করণে দূরপাল্লার বাসগুলো ঢাকা থেকে বের হতে ও প্রবেশ করতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এয়াড়া পুরান ঢাকার সায়েদাবাদ ও ফ্লাইওভারের নিচ, মতিঝিল বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনের রাস্তায় গড়ে উঠেছে টেম্পু স্ট্যান্ড।
মতিঝিল-দৈনিক বাংলা দিলকুশা,আরামবাগ-ফকিরাপুল,গুলিস্তান, আজিমপুরের একাধিক স্পটে সড়কের ওপরই বাস টার্মিনাল করা হয়েছে। এসব এলাকার মূল সড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দূরপাল্লার বাস পার্কিং করে রাখা হয়। এ কারণে এসব এলাকার মূল সড়কের বেশকিছু অংশ ব্যবহার করা যাচ্ছে না। কমলাপুরের টিটিপাড়া ও কমলাপুর অতীশ দিপঙ্কর সড়কের ওপর কার্গোসহ মালামালে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখার কারণে রাস্তার অর্ধেক দিয়েও যানবাহন চলাচল করতে পারছে না।
গুলিস্তানের বঙ্গবন্ধু স্কয়ার এলাকাসহ সব জায়গায়ই দোকান ও রাস্তায় বাস দাঁড় করিয়ে রাখার কারণে ব্যবহৃত হচ্ছে না সড়কের প্রায় অর্ধেক অংশ। গুলিস্তান থেকে সদরঘাটে যেতে প্রতিদিনই সুরিটোলা মোড় থেকে নয়াবাজার মোড় পর্যন্ত ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয় যাত্রীদের। এ দুর্ভোগের কারণ বংশাল-মালিটোলা এলাকায় রয়েছে বেশ কয়েকটি কুরিয়ার সার্ভিস ও ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি। রাস্তায় সারিবদ্ধভাবে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখেই কুরিয়ারের গাড়িগুলোতে পণ্য উঠানো নামানো হয়।
গুলিস্তান-সদরঘাটে ২০০ লাইনম্যানের চাঁদাবাজি: গুলিস্তানের গোলাপশাহ মাজারের পাশের গলিতে, ফুলবাড়িয়া ফ্লাইওভারের নিচে, স্টেডিয়ামের অপরদিকের রাস্তায় এবং সদরঘাট, ভিক্টোরিয়া পার্ক ও লক্ষ্মীবাজার এলাকায় সড়ক ও ফুটপাত হকারদের অভয়ারণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক’দিন পরপরই এসব জায়গায় উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। এরপর কিছুদিন হকারের দৌরাত্ম্য বন্ধ থাকে। এরপর আবার যেই সেই অবস্থা। এসব এলাকায় রাস্তায় বসার জন্য হকারদের কাছ থেকে প্রতিদিন মোটা অংকের টাকা নেয় কয়েকটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। জানা গেছে, সড়কে অবৈধভাবে বসা হকারদের নিয়ন্ত্রণ করে লাইনম্যানরা। ২০০ জন হকারকে একজন লাইনম্যান নিয়ন্ত্রণ করেন। আর এই একজন লাইনম্যানকে নিয়ন্ত্রণ করে পুলিশ-রাজনীতিবিদরা। কয়েকদিন পর লাইনম্যান বদলে নতুনদের নিয়োগ দেওয়া হয়।
একজন ব্যবসায়ী জানান, গুলিস্তান এলাকায় প্রতিদিন ৫০ জন ফুটপাত থেকে চাঁদা আদায় করে। আর চাঁদাবাজির এই পুরো কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করছেন দুলাল নামে এক ব্যক্তি। যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে, দুলাল সেই দলের নেতাদের হয়ে কাজ করে। রাজনৈতিক মদদ ছাড়াও স্থানীয় থানা পুলিশের অসাধু কিছু সদস্যের সহযোগিতায় হকারদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে দুলাল। বিনিময়ে সড়ক দখল করে দোকান বসানোর অনুমতি পান হকাররা। গুলিস্তান এলাকাতে থাকা ৫০ জন লাইনম্যান হকারদের কাছ থেকে টাকা তুলে আর দুলাল এই লাইনম্যানদের কাছ টাকা নেন। একটা অংশ পুলিশকে দেয় সে। আরেকটা অংশ চলে যায় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের পকেটে। বাকি অংশ দুলাল ও তার লোকেরা ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়। এছাড়া লক্ষ্মীবাজার ও সদরঘাট এলাকায় চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ করেন মোহাম্মদ ফিরোজ। তিনি কমপক্ষে ১৫ জন লাইনম্যানের মাধ্যমে হকারদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে তাদের রাস্তায় বসার ব্যবস্থা করে দেন।
নিউমার্কেটেও আদায় হয় দৈনিক ২০ লাখ: এছাড়া পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা ও লাইনম্যানদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে রাজধানীর নিউমার্কেটের সড়ক ও ফুটপাতও। এসব সড়কে বসা হকারদের কাছ থেকে প্রতিদিন ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ৩ হাজার টাকা চাঁদা নেয়া হয়। প্রতিদিন চাঁদা আদায় হয় কমপক্ষে ২০ লাখ টাকা। হকার, হকার্স লীগের নেতা ও গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
শুধু তাই নয়, ফুটপাতে দোকান বসাতে দৈনিক চাঁদার পাশাপাশি গুনতে হয় মাসিক চাঁদা। আর এই চাঁদার ভাগ পায় পুলিশ, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসন। নিউমার্কেটের পশ্চিম পাশের লাইনম্যানের দায়িত্বে আছেন ছাত্তার মোল্লা। তিনি স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা। পূর্ব পাশে লাইনম্যানের দায়িত্ব পালন করেন ইব্রাহিম ইবু। ইসমাইল, বিপ্লব, মোরশেদসহ একাধিক লাইনম্যানের নামও এসেছে অনুসন্ধানে।
দৈনিক ৭০ কোটি টাকা চাঁদা আদায়: তথ্য বলছে, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনভুক্ত এলাকায় হকার আছে প্রায় দুই লাখ। গড়ে একজন হকার ২০০ টাকা দিলেও প্রতিদিন চাঁদা উঠে ৪০ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ফুটপাতের হকারদের কাছ থেকে বছরে এক হাজার ৮২৫ কোটি টাকা চাঁদা আদায় হয়। প্রতিদিন আদায় হয় ৬০ কোটি টাকারও বেশি। তখন ঢাকায় হকার ছিল ৩ লাখ। এখন প্রায় সাড়ে তিন লাখ। সে হিসেবে এখন এই দুই সিটিতে সড়কে হকারদের বসতে দেয়ার বিনিময়ে প্রায় ৭০ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হয় প্রতিদিন।
মিরপুরে ১২০ ফুট সড়কের ১০০ ফুটই দখলে: মিরপুর ১১ নম্বরে ১২০ ফুটের সড়কের ১০০ ফুটই দখল হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত আছে মাত্র ২০ ফুট। লালমাটিয়া থেকে কালশী ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয় পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার সড়ক দখল করে ট্রাকস্ট্যান্ড করা হয়েছে। প্রভাবশালীরা এ সড়ক দখলে নিয়ে ট্রাকস্ট্যান্ড বানিয়ে সেখান থেকে রীতিমতো ভাড়া আদায় করছেন। ট্রাকস্ট্যান্ডটি গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে মিরপুরের লালমাটিয়া ও অ্যাভিনিউ ৮ এর বাসিন্দাদের জন্য। জমি থাকলেও অনেকেই তৈরি করতে পারছেন না বাড়ি। উপরন্তু মাদকসেবী আর ছিনতাইকারীদের হটস্পটে পরিণত হয়েছে এলাকাটি। ২০১৬ সাল থেকে অ্যাভিনিউ ৮ এর সড়কটিতে ট্রাক রাখা শুরু হয়। গত ৬ বছরে ১২০ ফুটের সড়কটি পরিণত হয়েছে সম্পূর্ণ একটি ট্রাকস্ট্যান্ডে। অভিযোগ রয়েছে এখানে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান কিংবা পিকআপ রাখতে গুনতে হয় দৈনিক এবং মাসিক ভিত্তিতে চাঁদা। প্রশ্ন হচ্ছে সরকারি রাস্তা দখল করে ভাড়া দিল কারা?
অভিযোগ রয়েছে, মেয়র এবং স্থানীয় সংসদ সদস্যকে বিষয়টি বেশ কয়েকবার অবহিত করার পরও আবাসিক এলাকায় ট্রাকস্ট্যান্ডটি আছে আগের মতোই। প্রতিটি ট্রাক, কাভার্ডভ্যান এবং পিকআপের জন্য আলাদা আলাদা টাকা দিতে হয়। মাসিক সর্বনিম্ন ১ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৪ হাজার টাকা। এ টাকার একটি অংশ যায় স্থানীয় রাজনীতিবিদ এবং প্রশাসনের পকেটে। তবে অনেকেই এ বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি নন। জনসাধারণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
Leave a Reply