পরিবারের আরেকজন সদস্য বাড়ানোর বিষয়ে ব্যাপক আগ্রহ মিনুর। সেটা হতে পারে আরেকটি ভাই অথবা আরেকটি বোন। গড়গড় করে বলতে থাকে-আমি তার থাতে থেলা তরব? বাতায় তো তেউ আমাল থাতে থেলে না।
আসলে মিনুর অভিযোগটা এমন,তার যোগ্য সাহচর্য্য নেই। বাসায় সারাক্ষণ পায়চারি করে সে। ওর মা যে দুপুরে কাজের শেষে একটু বিশ্রাম করবে,সে জোঁ নেই। একদিন দুপুরে মিনুর মা একটু ঘুমিয়েছে,ঠিক তখনই পই পই করে মায়ের কক্ষে মিনুর প্রবেশ। ‘মা,ওথো,ওমা ওথো।’ বেশ বিরক্তির সুরে ওর মা বললো,‘কেনরে?আমি একটু বিশ্রাম করি,তুই কি সেটা সহ্য করতে পারিসনা।’ একটু থতমত খেল মিনু। আবারও বলতে লাগল মিনু-‘‘মা,আম গাতে পাথি বতেছে। ওর থুব থিদে পেয়েছে। তলো মা, পাতির থেতে দাও। ’’
মিনুর মা চেয়ে দেখে,সত্যি তো। একটা কাক আম গাছে বসে মাথা একবার ডালের এদিকে,একবার ওদিকে টেনে টেনে উঁকি মারছে। হাড়ি থেকে ভাত বের করে গাছের নীচে ছড়িয়ে দিল মিনুর মা। গাছ থেকে কাকটা নেমে ঠুকরে ঠুকরে ভাত খেতে শুরু করলো। মিনু আনন্দে নাচতে নাচতে হাতে তালি দিতে লাগল। হাতে একটা তালি দেয়,সাথে একটা লাফও দেয়। কাকটা ভয়ে আবার গাছে উঠে যায়। অমনি ভ্যাক করে মিনু কেদে দেয়। মিনুর মা ওকে বুঝিয়ে বলে,‘‘তুই যদি সামনে যাস,তবে কাক চলে যাবে। আয়, ঘরে আয়।’’ মিনু ঘরে এল ঠিকই,কিন্তু ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে আরেকটা জিনিস। ও একটা কাক পুষতে চায়।
মাকে জিজ্ঞাসা করলো মিনু——‘‘মা,ওল বাথুর নেই?’’
উত্তরে ওর মা বললো,‘‘বাছুর নেই,তবে কাকের বাচ্চা থাকে। ’’
আমাল একতা বাত্তা এনে দাও-আবদারে অনড় থাকে মিনু।
মিনুর বাবা বাসাতে আসলেই ভেতরের ঘর থেকে দৌড়ে আসে মিনু।
‘‘বাবা,আমাল একতা বাত্তা নাগবে।’’ কিছুটা বিস্মিত হলেও পরে ওর মা সব খুলে বলে। সবশেষে সিদ্ধান্ত হয় বাসাতে একটা পাখি পোষা লাগবে। এনিয়ে পারিবারিক একটা বোর্ড বসলো। বড় মেয়ে বললো,ময়না পাখি পোষা যাক। কথাও বলবে,আবার মিনুর শখও পূরণ হবে। তবে ওর মায়ের পরামর্শে গ্রাম থেকে গাঙ শালিকের বাচ্চা আনা হলো। সাথে আনা হলো খাঁচাও। গাঙ শালিক নাকি মানুষের মত কথা বলে।
সেদিন থেকে বাড়ির চেহারায় যোগ হলো নতুন মাত্রা। পাখির নাম রাখা হলো ‘মিঠু’। মিঠু তো পাখির বাচ্চা নয়,পরিবারের নতুন অতিথি। রুটিন করে তাকে খাওয়ানো,খাঁচা পরিস্কার করা মিনুর মার একটা বাড়তি দায়িত্ব। মিনুর মা যখন পাখিটাকে খেতে দেয়,মিনুর সেখানে দাড়ানো লাগবেই। বায়না ধরবে,ও খাওয়াবে। তবে বাচ্চাটা থেকে যতসম্ভব দূরে রাখা হয় দস্যি এই মেয়েটাকে। অনেক দিন কি হয়েছে,হাত দিয়ে পাখিটাকে টিপে ধরে মিনু। এতে মিনু অপার আনন্দ পেলেও পাখিটার প্রাণ যায় যায় অবস্থা হয়। কোন কোন দিন মিনুর বাবা যখন বাসা থেকে বের হয়,অমনি পাক্কা বুড়ির মত সামনে দাড়াবে মিনু। ‘‘তলা আনবা,আর ধাল’’-মিনুর এই কঠোর আদেশ অমান্য করার দূ:সাহস ওর বাবার নেই। এমনভাবে চলতে লাগল বেশ অনেক দিন। পাখিটাও গায়ের শিশু ভোল পাল্টে চকচকা হতে লাগল। মিনুও আধো-আধো বোল থেকে কিছুটা জড়তা কাটিয়ে কথা বলতে শিখল। শিশুকে লেখা-পড়া করানোর জন্য পরিবারের মধ্যে যেমন একটা সাজ-সাজ রব শুরু হয়, পাখিটাকেও কথা বলানোর জন্য রীতিমতো পারিবারিক অভিযান শুরু হয়ে গেল।
পাখিটাকে কথা বলানোর জন্য গুরুদায়িত্বটা আপনা থেকে মিনুই নিল। কারণ পরিবারের মধ্যে মিনুরই কোন কাজ নেই। আর অন্যদের কোন ফুসরত নেই।
পরের দিন ঘুম থেকে মিনু উঠেছে খুব ভোরে। চোখ মুছতে মুছতে পাখির কাছে হাজির। চারিদিকে তখনও রাতের আবছা আবছা অন্ধকার। কবুতরের বাকবাকুমের মত বগরবগর শুরু করলো মিনু।
মিঠু,বলো—মিনু ওঠো,ওঠো মিনু। বাবার চা দাও,বাবার চা দাও। বলো-
পাখিটা তখন ধড়পড় করে উঠে ডানা ঝাঁপটাতে লাগল। যখন পাখি কিছুই বলছেনা,তখন মিনু খাঁচা ধরে ঝাঁকুনি দিতে শুরু করলো। ঝাঁকুনির চোটে কৎকৎ করে উঠল পাখিটা। আনন্দে লাফাতে লাফাতে মিনু বাবাকে বেড থেকে টেনে তুলল।
‘‘এসো বাবা,এসো। দেখ,পাখি কথা বলছে। ’’
মিনুর বাবা মিনুর দস্যিপনাতে কখনো বিরক্তি প্রকাশ করেনা। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পরে যখন বাসায় ফেরে,তখন মিনুর বগরবগর যেন টনিকের মত শক্তি দেয় তার মনে।
মিনুর বাবা তৎক্ষণাৎ উঠে প্রবল আগ্রহে পাখির কাছে আসল। মিনু প্রবল আশা নিয়ে বলতে শুরু করলো,‘‘মিঠু, কথা কও,ও মিঠু কথা কও।’’ কোন সাড়া নেই। মিনু রাগে আবারও খাচা ঝাঁকাতে লাগল। ঝাঁকুনিতে আবারও যখন মিঠু কৎকৎ করে উঠল,তখন ওর চোখে মুখে সেকি আনন্দ! ‘‘দেখ,বাবা,মিঠু, কথা বলেছে।’’ ওর বাবা সব বুঝেও মাথা নেড়ে বললো,‘‘তাইতো,মিঠুতো ভাল কথা বলতে শিখেছে।’’
বেশ কিছুদিনের মধ্যে মিঠু কথা বলা শিখেছে। ভাল আছেন? বসেন,বসেন। চা খান,চা খান। মিনু ওঠো,ওঠো,সকাল হয়ে গেছে। এমন আরও বেশ কিছু কথা শিখেছে সে।
এমনভাবে পার হয়ে গেল আরও কয়েক মাস। মিঠু আরও হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে। সারাক্ষণ শেখানো বুলি আওড়াতে থাকে। তবে গোল বাঁধল অন্যখানে।
মিঠুর পরিচর্যার অভাব নেই। নেই খাদ্যের অভাব। এমনকি মিনুর সাহচর্য্যও সবসময়। তবুও ইদানিং খাচায় ঘনঘন ঠোকর মারছে সে। হয়ত সে এতদিনের বন্দী জীবন থেকে মুক্তি চায়। বাইরের গাছে যখন পাখি বসে, তখন সে যেন বের হওয়ার জন্য খাঁচায় জোরালোভাবে মাথা ঠোকে। উন্মুক্ত আকাশে পাখা মেলে ওড়ার সাধ পেতে মরিয়া হয়ে উঠে মিঠু। খাঁচার ভেতরে ফলমুল আর ভাল ভাল খাবারের চেয়ে তখন তার কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে ঝোপঝাড় ও বনবাদাড়ের পোকামাকড় ও ফেলানো খাদ্য।
বিষয়টি নজরে আসল মিনুর বাবার। এমনিতেই তিনি খুব মানবিক মানুষ। বুদ্ধি আটতে লাগলেন কিভাবে পাখিটাকে বন্দী খাঁচা থেকে মুক্তি দেওয়া যায়।
বাসাতে সেদিন কেউ ছিলনা মিনু আর ওর বাবা ছাড়া। মিনু ঘরে খেলছিল। ওর বাবা চুপিসারে বাইরে থেকে ছিটকানি দিয়ে সন্তর্পণে দরজার পাশে দাড়ালো। কয়েক মিনিটের মধ্যে বাইরে বের হওয়ার জন্য দরজা টানতে লাগলো মিনু। বেশ কিছুক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করলো। একপর্যায়ে বাবা,বাবা বলে ডাকতে লাগলো। তাতেও সাড়া না পেয়ে চিৎকার করে কাদতে লাগলো। বিষয়টি আর বাড়তে না দিয়ে বাবা ছিটকানি খুলতেই মিনু ওর বাবার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে ফোপাতে ফোপাতে কাদতে লাগলো।
মিনুর বাবা বুঝলো,এটাই মোক্ষম সময়। মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললো,তুমি কাদছিলে কেন,মা?
‘দরজা আটকানো ছিল, তোমাকে খুজে পাচ্ছিলাম না তাই। ’
ওর বাবা বলতে শুরু করে, ‘‘দেখ,মা,মাত্র পাঁচ মিনিট তুমি ঘরে আবদ্ধ ছিলে। মাত্র পাঁচমিনিট তুমি কাউকে ঘরে পাওনি। তাই তোমার এত খারাপ লাগা। আর পাখিটা জন্মের পর থেকে ওর মাকে পায়নি। জন্মের পর থেকে ও ঘর থেকে বের হয়ে বাইরে খেলতে পারিনি। অতটুকু খাচায় ওর বন্দী জীবনটা। ওরও তো মা আছে। ওতো চায় ওর মার সাথে বসে গল্প বলতে। এখন তুমিই বলো,ওকে কি মার কাছে পৌছে দেওয়া আমাদের উচিৎ নয়?’’
মন্ত্রমুগ্ধের মত কথাগুলো শুনছিল মিনু। প্রত্যেকটা কথা যেন ওর মাথায় ধাক্কা খাচ্ছিল। ছোট মানুষ বলে হয়ত ওর উপলব্দিটা রহস্যঘন। খানিকটা পরে মুখ খুললো মিনু। ‘‘বাবা,ওর মা কোথায় থাকে?’’
‘‘তোমার দাদা বাড়ি যেতে দক্ষিণ মাঠে। আমি সেদিন আসার সময় ওর মাকে কাদতে দেখেছি।’’
কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে মিনু মিঠুকে বললো,‘‘ তুমি কেদনা,মিঠু। কালকে তোমাকে তোমার মা’র কাছে পৌছে দেব। ”
নির্ধারিত একটা দিনে পাখিটাকে নিয়ে বের হল ওরা তিনজন।
যাত্রাপথে দৃশ্যপট ধীরে ধীরে পাল্টে যেতে লাগল। কেমন যেন মনের মধ্যে টসটসানি বেড়ে যেতে লাগল মিনুর মা ও বাবার মনে। এতদিন সন্তানের মতই দেখেছে পাখিটাকে। বাজার থেকে ফিড আনাসহ অনেক কিছুই করেছে মিনুর বাবা। আর মিনুর মাতো আরও একধাপ এগিয়ে। পাখিটার খাঁচা পরিস্কার করা থেকে আরম্ভ করে সবকিছু করেছেন তিনি। ঘরময় শব্দ করে পাখিটা মা ডাকতো তাকে। কিছুক্ষণের মধ্যে ফাকা জায়গাতে এসে পড়লো ওরা। খাঁচা থেকে পাখিটা বের করে মুক্ত আকাশে উড়িয়ে দিল মিনুর মা। কিন্তু কি আশ্চর্য্য! ওড়াল দেওয়ার পরিবর্তে ওর মায়ের ঘাড়ে এসে বসল পাখিটা। যে পাখিটা খাঁচা থেকে বের হওয়ার জন্য ছটফট করত,খাঁচার ধারালো শিকে মাথা রক্তাক্ত করেছে যে,সেই যেন তার কাঙ্খিত স্বাধীনতাকে চিনতে পারছেনা। হাউমাউ করে কেদে উঠলো মিনুর মা। মিনুর বাবা পাখিটাকে ঘাড় থেকে নামিয়ে একটা গাছে বসিয়ে দিল। কিছুক্ষণ পরে উড়াল দিয়ে আরেকটি ডালে বসল মিঠু। পশ্চিমা আকাশের রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে সবখানে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে দেখে মিনু আর ওর মাকে বাইকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো ওর বাবা। মিনুর বাবার কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল সেই গান–‘‘পোষা পাখি-ছাইড়া দিলাম,গেলি উড়িয়া’’
Leave a Reply