‘সোনাপাখি,তোমার জন্য আমার জান খাই-খাই করে। শরীর-মনে ঝড় বয়ে যায় তোমার কথা মনে পড়লে। এই বৃষ্টিস্নাত রাতে যদি তুমি আমার পাশে থাকতে,ইশ—-। কয়েক মুহুর্ত চুপচাপ তারপর আবার–। বাদ দাওতো সিরাজের কথা। মামলা-মোকদ্দমা আর পাওনাদারদের যে চাপ আছে,তা তুমি সামলাতে পারবেনা। তাইতো ওই—টাকে সাইনবোর্ড করে ঝুলিয়ে রেখেছি। কাজ যেদিন উদ্ধার হয়ে যাবে,ওই—-টাকে বুকের খাচায় লাথি মেরে তোমাকে বিয়ে করব।’
সেলফোনে পরপুরুষের সাথে দীর্ঘ দশ বছরের প্রিয়তমা স্ত্রীর এমন কথা শুনে মাথায় বাজ পড়লো সিরাজের। টর্নেডোর ছোবলে সুপারী গাছের মত তার শরীর টলছে।
আসলে সেদিন ১০ কি.মি. দূরে ইলার কাছে যাওয়ার কথা ছিলনা তার। দুপুরে পেশাজীবীদের একটা অনুষ্ঠানে তিন প্যাকেজ বিরিয়ানি পেয়েছিল সে। বিকেলে একনাগাড়ে কয়েকঘন্টার বৃষ্টি। তাই রাতে যাত্রা। সন্ধ্যা রাতে লাইট অফ দেখে আর হাল্কা ফিসফিসানি শুনে দেয়ালে কান রেখেছিল সে।
দেয়াল থেকে কান সরিয়ে পিলার ধরে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা কররো সিরাজ। ফিরে গেল নিজের অভিশপ্ত ৯ বছর বয়সে।
বাবা মারা গেছেন মাস দুয়েক। শহরে একখন্ড জায়গা ছাড়া তেমন কিছু রেখে যেতে পারেননি তিনি। ভাইয়েরা তখন যে যার কাজে ব্যস্ত।
জামা-প্যান্ট পরতে বলেছিল মা। অবশ্য সেই জামা-প্যান্টে চিমটি দিলে ময়লা উঠে। সকাল বেলা মা চুলে হাত দিয়ে সিথিটা ঠিক করে দিয়েছিল। আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে যাবে বলে আনন্দের সীমা ছিলনা সিরাজের। বহুদিন ভালো খাবার খাওয়া হয়নি। চর্বি-যুক্ত মাংসের প্রতি তার আশৈশব লোভ। সকাল থেকে অনেকবারই মাকে জিজ্ঞাসা করেছে, তারা কোথায় যাচ্ছে। মা উত্তর দেয়না, শুধু চোখ মোছে। অবশেষে সিরাজের জায়গা হলো এতিমখানায়। এতিমখানায় তাকে রেখে যখন মা চোখ মুছতে মুছতে পেছন ফিরে তাকাচ্ছিল, বড্ড নিষ্ঠুর মনে হচ্ছিল তাকে। খুব জানতে ইচ্ছে করছিল,‘ ৬ মুট ভাত আর এক চিমটি লবনের দাম কত,মা ?’’
ক্ষুধার জ্বালা ও মা’র জন্য পরাণ পোড়া ছাড়া জীবনকে উপলব্দি করার বয়স তখন হয়নি সিরাজের। কিন্তু এখন একটা জিনিস মেলাতে চেষ্টা করে সে। জেল খানা আর এতিম খানার মধ্যে পার্থক্যটা কি! খুবই নিম্মমানের সিকে পেটা খাবার আর বাউন্ডারী বেষ্টিত বন্দীত্ব জীবন এতিমখানায়। পোশাক-পরিচ্ছদও বছরে ২টা। কয়েক জায়গায় সেলাই দেওয়া গামছা সাপ্তাহিক ছুটির দিনে পরতে হতো যখন প্যান্ট দুটো রোদে মেলে শুকাতে হতো। আর কর্তাদের খুশি করতে বাড়তি শ্রম আর খিস্তি খিউড় তো আছেই। মেধাবী হওয়ার কারণে সেখানেই কিঞ্চিত লেখাপড়া চালিয়ে যেতে লাগল সিরাজ।
৬ বছর পরে ডাক এল এতিমখানা থেকে বেরিয়ে আসার। মুক্তির আনন্দে ভেতরের কিশোর সত্বাটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। উফ! পাতায় ভরা আমগাছে উঠে কাচা-পাকা আম আর তলায় পড়া কাল জাম খেয়ে দাত-ঠোট কালছে করার বুনো আনন্দ! স্টাফ রুমে এসে আগন্তুক তিনজনের মধ্যে একজনকে চিনতে পারলনা সে। বোনই পরিচয় করিয়ে দিল,‘‘তোর দুলাভাই’’।
ব্যাংক কর্মকর্তা বোনজামাইয়ের বাড়িতেই সিরাজের নতুন ঠিকানা। সেদিনই বুঝতে পারল সে,কেন বোন আর বোন-জামাই এত মনে করে তাকে এতিমখানা থেকে বের করে এখানে এনেছে। হাড়ি-পাতিল মাজা থেকে শুরু করে বোনের পেটিকোট পর্যন্ত সব ধোঁয়ার দায়িত্ব তার। বোনের রান্নার ফুট-ফরমায়েশ থেকে আরম্ভ করে দুই ভাগ্নের পেসাব-পায়খানা মাখানো কাঁথা-পোশাক ধোয়াও ছিল তার নিত্য কাজ।
পাশের একটা স্কুলে তাকে নবম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়েছিল। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে রাতে দু’একঘন্টা পড়তে ভুল করতনা সিরাজ। এভাবেই দিন কাটতে লাগল। বোনের বাড়িতে থেকেই সে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি নিল। গোল বাঁধল অন্যখানে। সিরাজের শখ ছিল স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়া। কিন্তু বাইরে পড়তে যাওয়াকে বাড়তি ঝামেলা মনে হচ্ছিল বোনের। একদিন লেখাপড়া শেষ করার ইচ্ছা জানাতেই বোন সাফ জানিয়ে দিল, ‘‘দেখ, সিরাজ,অনেক করেছি। আর না,আমাদেরওতো ভবিষ্যৎ ভাবতে হবে!’’
‘‘আমাকে কাজের লোকের মত ব্যবহার করেছ এতদিন। আজ যখন পড়ালেখার জন্য বাইরে যেতে চাচ্ছি,তখন আমাকে বোঁঝা ভাবছ।’’ সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলল সিরাজ। এখানে আর এতটুকু নয়। নিজ এলাকায় ফিরে এসে অন্যজীবনে ঢুকে পড়ল সে।
বন্ধু আকরামের ভিডিও দোকানে ৬শ’ টাকা বেতনে চাকরি নিল। কাজ বিয়ের ভিডিওগ্রাফি। বিয়ের অনুষ্ঠানে ক্যামেরা চালানো অনেক ধৈর্য্যরে আর পরিশ্রমের কাজ হলেও সে ভারমুক্ত। মুক্তির আনন্দে কার না গর্দান ফুলে উঠে! মাত্র দু’বছরের মধ্যে নিজেই ভিডিও ক্যাসেটের দোকান দাড় করালো সিরাজ।
একদিন দোকানের সাটার খুলতেই সামনে হাজির এক তরুণী। অনেক মেয়েই আসে তার দোকানে ক্যাসেট নিতে। কিন্তু শিক্ষক প্রশিক্ষণের পোশাক পরা এই তরুণীকে এক দেখাতেই ভাল লেগে যায় তার। আলাপ-পরিচয় পর্ব শেষে ক্যাসেট নিয়ে তরুণী চলে গেল। তবে তার হাসি আর ঠোট ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কথা বলার মধ্যে অন্যরকম আবেশ অনুভব করল সে। সেই শুরু। প্রশিক্ষণ শেষে তার দোকানে আসা ছিল তরুণীার রোজকার ডিউটি। এভাবেই কেটে গেল আরও ১বছর। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো অচিরেই বিয়ে করবে তারা।
নারীদের সম্পত্তি ভাবা এক ধরণের পৌরুষদীপ্ত কর্তৃত্ববাদি প্রকাশ বৈকি। তবে ভালবাসার তীব্রতায় সেটা নারীদের কাছে সুখকর অনুভুতি। এভাবেই চলছিল বেশ। হানিমুন পিরিয়ডে (বিয়ের দু’বছর) দুজনের মধ্যে যে আবেগীয় ক্রিয়া থাকে,ধীরে ধীরে সেটা শুধু একে অপরের দায়িত্বের মধ্যে আটকে থাকে। সিরাজ দম্পত্তির মধ্যেও সেটা ব্যতিক্রম হলোনা। অবশ্য পেশাগত কাজের মধ্যে দুজন ডুবে থাকলেও দাম্পত্য সম্পর্কে চিড় ধরাতে পারিনি এতটুকু।
ইদানিং ইলার ফোনে বেশি কল আসে। একদিন সিরাজ বাসায় এসে ওয়াশরুমে ঢুকেছে,এমন সময় তার ফিসফিসানি কানে এল। সিরাজ বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়ে চেপে গেল। আরেকদিন সকালে ইলা ওয়াশরুমে ঢুকেছে,এমন সময় ফোন এল। সিরাজ ফোনটি ধরল। ওই প্রান্ত থেকে একজন পুরুষের কণ্ঠ। কল রিসিভারের সাড়ার অপেক্ষা না করে বলে গেল,‘‘আজকে আমি ঢাকায় যাচ্ছি,বিকেলে দেখা হবেনা। এসে সব বলব। এখন রাখি,বাই। কিছুক্ষণের মধ্যে গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে ইলা ওয়াশরুম থেকে বের হলো। সিরাজ কোনরুপ প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে বিষয়টি অবজার্ভেশনে রাখল।
সপ্তাহ খানেক পর সিরাজ বিকেলে ইলার স্কুলের দিক দিয়ে যাচ্ছিল অন্য একটা কাজে। কি ভেবে সে চাঁরটার দিকে স্কুলে হাজির হলো। কিন্তু কি আশ্চর্য্য! ইলা দুপুরের পরপরই বেরিয়ে পড়েছে স্কুল থেকে। ইলাকে না পেয়ে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল তার।
রাতে বিষয়টি নিয়ে স্ত্রীর সাথে কথা বললো সিরাজ। এমন মেজাজী ভাব এর আগে কখনো দেখেনি তার। সিরাজও কম যায়না। রাতে ধুন্দুমার কা- ঘটে গেল। ঝগড়ার এক পর্যায়ে হাত তোলা-তুলি। এইবার ইলার আসল চেহারা দেখল সে। খুব ঝাঁঝালো গলায় বললো ইলা—‘‘বেশি ফলাবানা,আমি ফলানো পছন্দ করিনা। ভাল না লাগে, তালাক দাও।’’
এমন ডায়ালগ শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলনা সিরাজ। চিরচেনা পোষ মানানো বিড়ালটা যখন বাঘিনউ রুপ ধারণ করে,তখন হতবাক হয়ে ধপাস করে বিছানায় শরীরটাকে ফেলে দেওয়া ছাড়া অন্যকোন পথ থাকেনা কারো। রাতে আর ঘুম হয়নি তার। কাকডাকা ভোরে বাসা থেকে বের হয়ে সে দোকানে এসে বসল।
আবারও ছন্নছাড়া জীবন শুরু হলো সিরাজের। হোটেলের খাওয়া আর দোকানে থাকা। মাস খানেকের মধ্যে ইলার কোন খবর রাখেনি সে। হঠাৎ একদিন ইলা দোকানে এসে হাজির। ‘‘সামান্য একটা ঘটনায় তুমি এভাবে চলে আসলে?’’ চোখে চোখ রাখলে নাকি চোখাচোখি হয়,তবে তাদের চোখাচোখিকে রোখারোখি বলাই ভালো। এটাকে তুমি সামান্য বললে?’’ ক্ষুব্ধ না হয়ে সিরাজের হাতটা ধরে ইলা বললো, ‘সরি’। ব্যাস,হৃদয় থেকে নিমিষেই অভিমানের মেঘ গলে ওপরে উঠে চোখ দিয়ে ঝরতে লাগল। আসলে নারীবাদিরা পুরুষকে যেভাবেই চিত্রিত করুক না কেন,সত্যটা হলো নারীরা হলো পুরুষের কোমল বিছানা। বাইরে যাই করুক না কেন, রাত আসলে সেই স্বর্গ জমিনের খোজ করবেই। তাছাড়া সিরাজ ছোট-বেলা থেকে আদর বঞ্চিত হওয়ায় অন্যদের থেকে সে বেশি ভালবাসার কাঙাল। আবারো শুরু হলো একসাথে পথ চলা।
ইলার মধ্যে একটা অস্থিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। দেরিতে বাসায় ফেরা তার একটা রুটিন কাজ হয়ে পড়েছিল। প্রথমে সিরাজ সেটা বুঝতে পারিনি। ইলার অস্বাভাবিক পরিবর্তনের ফলে সিরাজ কাজের মহিলাকে স্পাই হিসেবে কাজে লাগিয়েছিল। মাঝে-মধ্যে বাসায় অচেনা এক পুরুষ আসত । আরও মাস খানেকের মধ্যে সিরাজ বুঝতে পারল,তার স্ত্রীর সাথে একাধিক পুরুষের অবৈধ সম্পর্ক। প্রথম থেকে সে আরও বুঝতে পেরেছে,ইলা শারীরিক চাহিদার দিক থেকে অস্বাভাবিক। এমন নারীদের বহুপুরুষ প্যাশন ও ফ্যাশনে পরিণত হয়। ইলার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বহুগামিতাকে সে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল।
নিজের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে লাগলো সিরাজ। আসলে বেশি যুদ্ধ করা লোকজন একপর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে শান্তি খোজে। অনেক কিছুর সাথেই তখন আপোষ করতে শেখে সে।
বিভিন্ন মাধ্যম দিয়ে খোঁজ নিয়ে সিরাজ খাতা-কলমে হিসেব করে দেখল ইলা ৪০ লাখ টাকা ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েছে। প্রতি মাসে সুদ গুনতে হচ্ছে পঞ্চাশ হাজার টাকারও বেশি। দাদা যেমন ছেলের চেয়ে নাতনীর কদর করে বেশি,সুদখোরদের কাছে আসলের চেয়ে সুদের দরদ বেশি। একপর্যায়ে সে নিশ্চিত হলো, ইলার সাথে রগরগে সুখকর মুহুর্তগুলো ভিডিও করে রেখেছে রিপন। এটাকে ঢাল হিসেবে সে প্রতিনিয়ত আয়ের উৎস্য হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে। ইলাও ভিডিও ফাঁস হওয়ার ভয়ে কখনো ব্যাংক থেকে লোন নেয়। আবার কখনো চড়া সুদে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে রিপনের হাতে তুলে দেয়। সিরাজও তার সঞ্চয়ের পনের লাখ টাকা তার কাছে তুলে দিয়েছিল তাকে উদ্ধার করতে। তবে ইলা মাছ ধরা জালের ফাঁদে পড়েছে। যতই বের হওয়ার চেষ্টা করছে,ততই সে বিভিন্ন জটিলতায় জড়িয়ে যাচ্ছে।
সৌন্দর্য্যরে সাথে উচ্চ শিক্ষা,এমন ধারালো ইস্পাতে শুকনো কাঠ থেকে আরম্ভ করে লোহাও কাটা যায় বেশ নিখুতভাবে। ইদানিং ইলা শরীরটাকে কাজে লাগাচ্ছে সবশেষ অস্ত্র ও উপায় হিসেবে। পতিতা নারীর কাছে পুরুষ যায় চোখের নেশায়। তবে সিরাজের বিষয়টা ভিন্ন। সবকিছৃু বুঝেও সে ইলার কাছে যেত শেষ আশ্রয় হিসেবে।
ঘন্টাখানেক ইলার কক্ষের সামনে এভাবে মুর্তির মত চুপচাপ দাড়িয়ে ছিল সে। বৃষ্টিও ঝরে আসছিল। বাইকটা স্টার্ট দিল। বাইকের শব্দে তার আসাটা ইলা বুঝতে পেরেছিল। কিছুদুর আসতেই ইলা ফোন দিল। সিরাজ না ধরে গুনগুন করে গাইতে লাগলো,‘‘ বন্ধু,নিঠুরিয়া,দুধ-ভাত দিয়ে পুষলাম তোরে যতন করিয়া,আজ তুই চইল্যা গেলি খাঁচা ভাঙ্গিয়া।’’
Leave a Reply