ডেস্ক রিপোর্ট ;
একই মায়ের গর্ভ থেকে একইদিনে জন্মগ্রহণ করেছে দুই সন্তান। কিন্তু তাদের পিতৃপরিচয় আলাদা। অবাক শোনালেও এমনটা ঘটেছে জাতীয় পার্টির প্রয়াত চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিকের দুই পুত্র সন্তানের ক্ষেত্রে। তাদের জন্ম তারিখ পিতার পরিচয় নিয়ে বড় ধরনের গোলকধাঁধা দেখা দিয়েছে। জন্মনিবন্ধন সনদে দেখা গেছে, দুই পুত্র শাহাতা জারাব এরশাদ (এরিক) এবং এরিক ওয়েন হুইসনের জন্ম ২০০১ সালের ১১ মার্চ। জন্মস্থান ঢাকা।
অর্থাৎ দুই সন্তানের জন্ম হয়েছে একইদিনে। কিন্তু শাহাতা জারাব এরশাদের (এরিক) পিতার নাম লেখা হয়েছে এইচএম এরশাদ এবং এরিক ওয়েন হুইসনের পিতার নামের ঘরে লেখা আছে পিটার স্টুয়ার্ট হুইসন। দুই পুত্র সন্তানের জন্মতারিখ একই দিন লেখা থাকায় ধরে নিতে হবে তারা যমজ ভাই। বিদিশা যমজ পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছেন।
কিন্তু তাদের পিতা দুজন হওয়ায় বড় ধরনের প্রশ্ন সামনে উঠে এসেছে। শুধু তাই নয়, জন্ম নিবন্ধনে দুই পুত্রের জন্ম ঢাকায় বলা হলেও বিদিশার পাসপোর্টের বিদেশ সফরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তিনি ওইদিন ছিলেন সিঙ্গাপুর। এছাড়া শুধু সন্তান নয়, বিদিশা তার নিজের জন্ম তারিখ নিয়েও দুরকম তথ্য দিয়েছেন।
শাহাতা জারাব এরিকের পিতৃপরিচয় নিয়ে এরকম চাঞ্চল্যকর তথ্য অমীমাংসিত থাকা অবস্থায় বর্তমানে বিদিশা সিদ্দিক অনেকটা নির্বিঘ্নে সময় পার করছেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এরশাদের বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কের বাসায়। আছেন ছেলের সঙ্গে। এইচএম এরশাদ ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই মারা যাওয়ার ৪ মাসের মাথায় নভেম্বরে বিদিশা এ বাসায় ওঠেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এরশাদ পরিবারের ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত সাতক্ষীরা-৪ আসনের জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি ও হুইপ এইচএম গোলাম রেজা বলেন, ‘চরম সত্য হলো- শাহাতা জারাব এরিক এরশাদ স্যারের সন্তান নন। বিদিশা প্রতারণা করে জন্মনিবন্ধনে পিতা হিসাবে এরশাদের নাম যুক্ত করেছেন। পারিবারিক আদালতে এ সংক্রান্ত মামলায় বিদিশা হেরে গেছেন। এরশাদের আইনজীবীর জেরার মুখে বিদিশা সব সত্য প্রকাশ করতে বাধ্য হন।’
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘নিম্ন আদালতে এ মামলায় হেরে যাওয়ার পর বিদিশা উচ্চ আদালতে আপিল করেন। আদালত বিদিশার আপিলও খারিজ করে দেন। আপিল নম্বর ৬১/২০১১। অথচ এখন আবার ওই ভুয়া পরিচয়কে সামনে এনে ছেলের মায়ের দাবি নিয়ে বিদিশা বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কে উঠেছেন। বিষয়টি খুবই অপ্রত্যাশিত ও বেআইনি।’ তিনি মনে করেন, ‘যেহেতু বিষয়টি একজন সাবেক রাষ্ট্রপতির পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ স্পর্শকাতর বিষয়। তাই সরকারের উচিত হবে যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে বিষটির একটি সুরহা করা।’
তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৫ সালের ৩ জুন বিদিশাকে তালাক নোটিশ পাঠান এরশাদ। অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের তালাকসংক্রান্ত সালিশি কেস নম্বর ১৬৬৫/২০০৫। এ সালিশের মাধ্যমেই তালাক কার্যকর হয় ওই একই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর। সে সময় এরশাদ-বিদিশার ছাড়াছাড়ি হলেও শিশুসন্তান শাহাতা জারাব এরিককে নিজের জিম্মায় রাখেন এরশাদ।
কিন্তু এটা মেনে নিতে পারেননি বিদিশা। তালাকের ৫ বছর পর অর্থাৎ ২০০৯ সালে শাহাতা জারাব এরিককে নিজ জিম্মায় নিতে পারিবারিক আদালতে মামলা করেন বিদিশা। মামলা নম্বর ৮৮৮/২০০৯। এ মামলায় এরশাদের আইনজীবী শেখ সিরাজুল ইসলামের দীর্ঘ জেরার মুখে বিদিশা তার জীবনের নানা কাহিনী প্রকাশ করেন।
বিদিশার জেরাসংক্রান্ত নথির এক জায়গায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন বিদিশা। তার প্রথম বিয়ে হয় ১৯৮৩ সালে। স্বামীর নাম পারভেজ আহমেদ। পাসপোর্ট নং এফ ২২১৩৫৫। বিদিশার জন্মস্থান ভারত হলেও পাসপোর্টে উল্লেখ করা হয় বাগেরহাট। তার জন্ম ১৯৬৭ সালের ১ জুলাই।
জেরার নথিতে দেখা যায়, বিদিশা নিজেই জানান, মাত্র ১৭ বছর বয়সে ১৯৮৪ সালে নাবালিকা অবস্থায় তার প্রথম বিয়ে হয় গ্রীন রোড কাজী অফিসে। এরপর দ্বিতীয় বিয়ে করেন বাবার বন্ধু সিঙ্গাপুরের নাগরিক পিটার স্টুয়ার্ট হুইসনকে। এ বিয়ের সুবাদেই সিঙ্গাপুরে গিয়ে বেশ কিছুদিন স্থায়ী বসবাস করেন তিনি।
ওই ঘরে তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে হয়। ১৯৮৭ সালের ২৩ নভেম্বর তার প্রথম ছেলে উইলিয়াম জেমস হুইসনের জন্ম হয়। ১৯৯০ সালের ১৬ জুলাই জন্ম নেন তার মেয়ে ইসাবেল ইমা হুইসন। তখন তিনি সিঙ্গাপুরের ২৭ এ নানইয়াং, ডাক-ভিউ, পোস্ট কোড ২২৬৩ এলাকায় বসবাস করতেন।
প্রতারণা যেভাবে : ২০০০ সাল থেকেই এরশাদ-বিদিশার প্রেম কাহিনী টক অব দি কান্ট্রিতে পরিণত হয়। আলোচনা গড়ায় খোদ জাতীয় সংসদে। তখন আলোচিত এ জুটির সম্পর্ক নিয়ে চারদলীয় জোট সরকারের সময় জাতীয় সংসদে প্রশ্ন তোলেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ।
যিনি এক সময় এরশাদ সরকারের উপ-রাষ্ট্রপতি ছিলেন। বিষয়টি সংসদে উত্থাপন হওয়ায় লোকলজ্জার ভয়ে একটি এফিডেভিট নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে তাদের বিয়ের বিষয়টি প্রকাশ করা হয়। তবে বিয়ের সপক্ষে কোনো দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এ এফিডেভিটের বলে ২০০০ সালের ২৭ মার্চ থেকে বিদিশা এরশাদের স্ত্রী বলে দাবি করার সার্টিফিকেট পেয়ে যান।
২০০০ সালের ২৩ নভেম্বর রাজনৈতিক কারণে জাতীয় নির্বাচনের আগে জনতা টাওয়ার মামলায় কারাবন্দি হন এরশাদ। এ মামলায় উচ্চ আদালতের আদেশে এরশাদের ৬ মাসের জেল ও ৫ কোটি ৪৮ লাখ ৭০ হাজার ৮০০ টাকা জরিমানা করা হয়। ওই সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন এরশাদ।
যে কারণে আদালত থেকেই তাকে ২০০০ সালের ২৩ ডিসেম্বর কারাগারে যেতে হয়। যদিও ৩ মাস পর ২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা জরিমানা দিয়ে জাতীয় পার্টির তৎকালীন চেয়ারম্যান জামিনে বেরিয়ে আসেন। ওই সময় এভাবে জেলে যাওয়ার কারণে তিনি বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে যুক্ত থাকতে পারেননি।
এদিকে এরশাদ কারাগারে থাকাবস্থায় ২০০১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুরে চলে যান বিদিশা। তখন তার পাসপোর্টে স্বামীর নাম পিটার স্টুয়ার্ড হুইসন। পাসপোর্ট নম্বর পি ০১৮৭৯০৯। সিঙ্গাপুরের ভিসা নম্বর সিবি ৫৮২২৯১। পাসপোর্টের তথ্য বলছে, ১৩ দিনের মাথায় ১৩ মার্চ সিঙ্গাপুরথেকে দেশে ফেরেন বিদিশা।
তথ্যানুসন্ধানে বিদিশার পাসপোর্ট ও এ সংক্রান্ত নথিপত্র থেকে জানা যায়!
Leave a Reply