সত্য ঘটনা অবলম্বনে
মেয়ের মেদহীন ছিপছিপে শরীরে পেট মোটা হতে দেখল রাজিয়ার মা। চোখ-মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আলানে সিলভার কার্প মাছের মতো হয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করতেই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে রাজিয়া। ধমক দিয়ে জিজ্ঞাসা করতেই কেদে ফেলে সাড়ে ১২ বছরের নিস্পাপ মেয়েটি। খুটিয়ে খুটিয়ে জিজ্ঞাসা করতেই মুখ খুলল শিশুটি।
বাড়িতে কেউ না থাকার সুযোগে উচু সীমানা প্রাচীর টপকে পালাক্রমে আসত দু’ভাই, রাজু ও সাজু। পালাক্রমে ছোট্র শিশুটির ওপর চলত অত্যাচার। একপর্যায়ে বাঘের থাবা থেকে কয়েক হাত দূরত্বে থাকা হরিণ শাবকের মতো কাপতে কাপতে বললো রাজিয়া,‘‘ওরা আমাকে চেপে ধরে——আর কিছু বুঝতে বাকী র’লনা রাজিয়ার মায়ের। বনবন করে মাথা ঘুরছিল। পাশবিক সুখ নিতে দুই সহোদরের এ সখ্যতায় বুনো প্রাণিগুলোও যেন লজ্জা পায়।
রাজিয়ার জন্মের কয়েক মাস পরে মারা যায় তার বাবা। মানুষের ঘর-দোর মুছে আর থালাবাটি মেজে নিজের আহার জুটিয়েছেন তিনি। আর খুব সুক্ষ্ভাবে পুরুষ মানুষের আহার থেকে নিজের সংবেদনশীল জায়গাগুলো বাচিয়েছেন ।
ভোররাতে পাশের কাউকে না জানিয়ে মেয়েকে নিয়ে গেলেন ডাক্তারের কাছে। মেয়েটি পুষ্টিহীনতায় কঙ্কালসার। চোখ-মুখ কোঠরে গেছে। ধর্ষকদের প্রতি ঘৃণা হচ্ছিল ডাক্তারের। শারীরিক সম্পর্কের সুখ হলো, বিপরীত লিঙ্গের মানুষটির তীব্র সুখানুভুতি। আর এরা! নারী দেহে খালাসেই যেন শান্তি পায়! নারী হলেও না হয় কথা ছিল। দুধের বাচ্চা বলতে হয়। তার ভেতরেই দুধ খাওয়ার জন্য আসছে আরেকজন! স্বাস্থ্য বিবেচনায় বাচ্চা নষ্ট করার ঝুুঁকি নিলেননা ডাক্তার।
অবস্থা বেগতিক দেখে রাজিয়াকে নিয়ে অনেক দূরে চলে গেলেন তার মা। বেশ কিছুদিন পর ক্লিনিকে রাজিয়ার একটি ছেলে সন্তান হলো।
সন্তানের মুখ দেখলে মায়েদের জন্ম দেওয়ার কষ্ট থাকেনা। রাজিয়ার কপালে সে সুখটাও জুটলনা। জঞ্জাল সাফ করে মেয়েকে দ্বিতীয়বার জীবন ফিরিয়ে দিতে শিশুটিকে বেঁচে দিল তার মা। কিছুদিনের মধ্যে নতুন জীবন শুরু হলো রাজিয়ার।
দত্তক নেওয়া ঘরে বড় হতে লাগল আলিম। তবে প্রতিবেশিদের মুখ আটকানো গেলনা। ওই মা-বাবা যে তার নিজের নয়,সেটা শুনতে শুনতে অসহ্য বিরক্তি এসে গেল দত্তক পিতা-মাতাসহ শিশুটির। মানুষের স্বভাব একজায়গায় এক ও অভিন্ন। অন্যের সুখে তার গা রিরি করবে,আর অন্যের দু:খে মন পুলকিত হবে। শেষমেষ ২৮ বছরের তরুণ ফিরে গেল মায়ের ঠিকানায়।
মহাকালের হিসেব মানুষের কাছে নেই। তবে একটা জায়গায় মনে হয় হিসেবটে এমনই হয়, অতীত ভবিষ্যতের পিছু পিছু ছোটে। এক ছেলেকে নিয়ে স্বামীর সংসারে ভালোই ছিলেন রাজিয়া। কিন্তু আলিম আসাতে জীবনটা আবারো অস্থিরতায় ভরে গেল তার।
বাড়িতে কেউ না থাকার সুবাদে রাজিয়াকে একদিন বিষের বোতল দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করল ছেলেটি,
‘‘আমার জন্মদাতার পরিচয় তোমাকে বলতেই হবে’’। চমকে উঠল রাজিয়া। তার মাঝখানে সিথি কাটা লম্বা চুলগুলো যেন তড়াক করে সোজা হয়ে গেল। তবুও আবেগ সামলে গুছিয়ে বলল,‘‘বাবা,শরীরের ধকল,মানের ধকল—সবকিছুতো আমাকে সইতে হইছে। এটা না হয় ছাই চাঁপা থাক।’’
কে শোনে কার কথা! বিষের বোতলের ছিপি খুলে গালে দিতে যাবে,এমন সময় রাজিয়া বোতলটা ফেলে দিয়ে সত্যটা তুলে ধরল ছেলের কাছে। একনাগাড়ে কথাগুলো ছেলেকে বলে ভয় আর লজ্জায় প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষা না করে ফুপাতে ফুপাতে কাঁদতে লাগল সে। আলিমের চোখও ততক্ষণে ভিজে উঠেছে।
সিদ্ধান্ত হলো আদালতে মামলা করার। কিন্তু মামলাতো মুখের কথায় হয়না। লাগে প্রমাণ। ছেলেকে পাশে পেয়ে রাজিয়ার জীর্ণ-শীর্ণ শরীরে যেন জোশ বেড়ে গেল। যে সীমানাপ্রাচীর বেয়ে দু’ভাই তার জীবনটাকে তছনছ করে দিয়েছে,সেই সীমানাপ্রাচীর ডিঙিয়ে যেভাবে হোক মামলার প্রমাণপত্র তাকে জোগাড় করতেই হবে।
প্রায় তিন দশক পরে মুখোমুখি হওয়ার সময় রাজিয়াকে দেখেই সাজু বলেছিল,‘‘তুই এখনো মরিসনি?’’। উত্তরে রাজিয়া বলেছিল,‘‘যদি আমাকে মরতেই হয়, তোদের ফাঁসির দড়িতে ঝুলানোর পর মরব।’’
অভিযুক্তদের ডিএনএ পরীক্ষা করে প্রমাণ মিলেছে,সাজুই আলিমের বাবা। মামলা চলমান রয়েছে। একদিন হয়ত আদালত তার সুচিন্তিত রায় দেবেন,কিন্তু বিশে^র কোণায় কোণায় যে শত-সহস্র মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটে যাচ্ছে,তার কয়টার হিসেব আদালতে আসে?
Leave a Reply